লকডাউনে শ্রী শ্রমিক আহমেদের আত্মকথা

লকডাউন : শ্রী শ্রমিক আহমেদের আত্মকথা
 
        শেখ রেজওয়ানুল ইসলাম
আমি শ্রী শ্রমিক আহমেদ।শিক্ষিত বেকার।তাই খেটে খাই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদে পুড়ে হেজে গলদঘর্ম হয়ে দুটো পয়সা কামাই।তাতেই পেট চলে আমার। আমার পরিবারের। আমার ছোট্ট মেয়েটার জন্য,না দুধ নয়; সুজি কিংবা বার্লি খাওয়াই। ওর মা পালা করে করে এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে।থালা বাসন মাজে,ঝাঁট দেয়,জল বয়। বিকেলটা হয়ে যায় দুপুর।তাই স্বাস্থ্যটা ভগ্ন।বুকের দুধ কবেই মরে গেছে।তাই মেয়েটা সুজি খায় আর আঙুল চাঁটে।তার ঠোঁটে সকরুণ হাসি।কেননা, পড়েছে তো পেটে কিছু একটা।তাতেই সই।
       আমার বৃদ্ধা মা দালানে বসে চুলের জট ছাড়ায়। রুগ্ন বাবা একা বসে বসে জাল বোনে। কাঠির এক একটা শব্দ এক একটা পয়সা যেন। সেই পয়সায় পথ্য কেনে। এভাবেই সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসে। আমার ভাঙা বাড়ির মাথায় এক চিলতে চাঁদ উঁকি মারে। মরিনি এখনও। অর্ধমারি নিয়ে জীবনএগিয়ে চলে। কিন্তু কাউকে কোনদিন দোষারোপ করিনি আমি।
   তোমরা যাকে বলো, 'দরিদ্রতা হলো মানুষের ন্যূনতম জীবনযাত্রা মানের উন্নীত হওয়ার অক্ষমতা'-Poverty means the inability of the people to attain a minimum standard of living'(বিশ্বব্যাংক) - আমি তাদেরই প্রতিনিধি। 'একজনের যা আছে এবং একজনের যা থাকা উচিত- এই দুইয়ের মধ্যেকার বিরোধের অনুভূমি যে অবস্থা সৃষ্টি করে'( রাম আহুজা)- আমার বন্ধুরা, আমার সহযাত্রীরা তারই দোসর, তারই শিকার। হ্যাঁ, আমরা সবাই 'খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা প্রভৃতির ন্যূনতম মান থেকে বঞ্চিত'(হ্যারিংটোন)। আমাদের এক শ্রেণী,এক নাম,এক ধর্ম,এক জাতি- দারিদ্র্য।আমাদের সবার মধ্যে এক মজ্জাগত আত্মীয়তাবোধ তৈরি হয়েছে- 'দারিদ্র্য' নামক ছোট্ট শব্দবন্ধে। তবুও আমরা কাঁদিনি। তবুও আমরা মরিনি। দোষ দিইনি ধর্মাবতার।
   যারা দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সমহারের পক্ষে সওয়াল করেন, তারা কি ঠিকই বলেন? জানি না। তবে এটুকু জানি, দেশের অধিকাংশ মানুষ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। যারা পান, তারা সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশই। সার্বজনীন উন্নয়নের মাপকাঠিতে 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম' যে সমীক্ষা চালিয়েছে, তাতে দেখা গেছে ৭৪ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৬২ তম- একেবারে তলানির দিকে।অক্লফ্যামের সমীক্ষা বলছে, আমাদের জাতীয় উৎপাদিত সম্পদের ৭৩ শতাংশ গেছে এক শতাংশ মানুষের হাতে ।কিন্তু তাতেও আমরা দোষারোপ করিনি। দুবেলা দুমুঠো ভাত তো পাই!সেটাই তো আমাদের পৃথিবী। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন পেটে খিদে নিয়ে ঘুমায় । সেটাও বা কম কিসের ? একজন না খেলে এমন কিছু যায় আসে না। বাকিরা তো খাচ্ছে-দাচ্ছে। চাটাই পেতে ঘুমাচ্ছে ।
   তোমরা এম পি আই (Multi-dimensional poverty index)এর সূচক দেখে খুশিতে টগবগ হও। ছাতি চওড়া করো। মনে মনে প্রবোধ দাও ,দেশের দারিদ্র্যের মাত্রা ৫৪.৭ শতাংশ থেকে কমে দাড়িয়েছে ২৭.৫শতাংশ। কিন্তু আমরা জানি, এখনো দেশের ৩৬.৪কোটি মানুষ অতি দারিদ্রের মধ্যে দিন গুজরান করে। এদের চার ভাগের এক ভাগ শিশু, যাদের বয়স দশের নিচে। কি বা যায় আসে তাতে? ১৩০কোটির ভারতে এটুকু জঞ্জাল তো থাকতেই পারে? আমরাও সহমত পোষণ করি। উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে তো আছি! মরিনি! সেটাই বা কম কিসের?
     দেশের শীর্ষ ব্যাংক ৫০ জন ঋণখেলাপির কাছ থেকে ৬৮হাজার ৬০৭কোটি টাকা মুকুব করতে পারেন। মেহুল চক্সির ৫৪৯২ কোটি, সঞ্জয় ও সন্দীপ ঝুনঝুনওয়ালা ৪৩১৪ কোটি, যতীন মেহেতার ৪০৭৮ কোটি,বাবা রামদেব ও আচার্য বালকৃষ্ণর ২২১২ কোটি। আরো। আরো।ধর্মাবতার, করোনা নিরাময়ের জন্য বিশ্ব ব্যাংক থেকে যে টাকা ধার নিয়েছেন, এই পঞ্চাশজনের যোগফল তার আট গুণ।কারোনার ঘোষিত আর্থিক প্যাকেজের ৩০%। এত বিশাল অঙ্কের অর্থ এতো সহজেই মকুব করতে পারেন। তা করুন। আপত্তি নেই।কিন্তু সেই ঋণের কোপটা যে আমাদের মত হাজার হাজার শ্রমিক মেহনতি মানুষের উপর পড়বে না, সে গ্যারান্টি কে দেবে? গ্যারান্টি নাইবা থাকুক। তবুও আমরা কাঁদিনি। হাসি।কেননা,মরিনি এখনও।
    কিন্ত  আজ বড় কষ্টে আছি।তাই দোষ দিতে ইচ্ছে হয়।চীন থেকে যেদিন প্রথম মারি আসে কেরালায়,সেদিনও আমরা ইটভাটার ঘানি টেনেছি।যেদিন ধর্মগুরু বলদেব সিং পাঞ্জাবের অলিতে গলিতে ঘুরছিল ,সেদিন আমরা কারখানার যন্ত্রদানবের সাথে যুঝেছি।নিজামুদ্দিনে যেদিন সবাই সমবেত হয়ে পরকালের যাঞ্চা মাঙছিল,সেদিন আমরা ইটের পরে ইট সাজিয়ে ইমারত তৈরিতে ব্যস্ত থেকেছি।তিরূপতি মন্দিরে যেদিন হাজার হাজার ভক্ত পূণ্য লাভে মশগুল ছিল,সেদিনও আমরা এমব্রয়ডারি মেশিনে নকশার ফোয়ারা ছিটিয়েছি।যেদিন গোমূত্র পানের পার্টি চলছিল,সেদিনও আমরা জরির সূঁচে শান দিয়েছি।যেদিন কণিকার শিল্পিত নৃত্য চলছিল,সেদিন আমরা মনের বালাই ভুলে কোদাল চালিয়েছি ।যেদিন 'হোল্লা মহল্লা' উৎসব চলছিল,সেদিনও আমরা কয়লা খনির গর্ভে 'হেইয়া ও হেইয়া' করেছি।মধ্যপ্রদেশে যেদিন সরকার বাহাদুরের শপথ গ্রহণ চলছিল,সেদিনও আমরা 'জ্বল খাবে জ্বল' বলতে বলতে পিঠে বজরা নিয়ে ছুটেছি।না, আমাদের কিচ্ছু যায় আসেনি তাতে।কেননা, পেটে দুটো দানা তো পড়েছিল তখন।কিন্তু আজ?
   যে শব্দটি জীবনে কখনও শুনিনি,সেটা আজ শিখে গেছি আপনাদের কল্যাণে।হ্যাঁ, 'লকডাউন'।আপনাদের কাছে এর অর্থ কি, জানিনা।আমাদের কাছে লকডাউন মানে পেটে খিল ,জল ফুটিয়ে বাচ্চাদের খাবার বানানোর মিথ্যে সান্ত্বনা,হা অন্ন জীবন,পথ্যহীন ধড়,পাঁজরার হাড় গোনা, খিদের যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে পাশ ফিরে শোওয়া।কিন্তু কেন?আমরা তো কোনো দোষ করিনি।'বাবু রোগ' এর জন্য আমাদের কেন এত কষ্ট সইতে হবে?আমার বাচ্চাটা কেন বই খাতা ফেলে ডিমের ঝুড়ি নিয়ে বসবে?আমার বাচ্চাটা ওষুধ কিনতে গিয়ে কেন লাঠির ঘা খাবে?কেন গুরগাঁওয়ের সদ্য মা হওয়া নিতু ভাতের অভাবে দিন দিন শুকিয়ে উঠবে?আঁচলের নবজাতকের দুধের পরিবর্তে আলুরদমে জীবন শুরু হবে? কি দোষ ছিল আমাদের?সেই সুটেড-বুটেড-কোটেড-জোব্বা ওয়ালাদের ভুলের মাশুল আমাদের কেন চোকাতে হবে?
        আজ সগর্বে বলতে চাই,আমরা না বাঁচলে আপনারাও কি বাঁচবেন?গ্রাম শহরে উঠতে কতক্ষণই  বা লাগবে?তাই বোধ হয় শহর বাঁচাতে গ্রামে এত জোর!নইলে,আমাদের প্রতি কি আইনের এত কদর হয়?হ্যাঁ,আপনার আইন বলবৎ করুন।কিন্তু তার আগে দুটো ভাতের ব্যবস্থা করুন ধর্মাবতার।রোগের হাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে,খিদের জ্বালায় মানুষ না মরে -এটুকু নিশ্চয়তা আপনাকে তো দিতেই হবে,তাই না।
      হ্যাঁ, আমরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করি। অশিক্ষার অন্ধকারে বেড়ে উঠি। আধপেটা খেয়ে বাঁচি।কিন্তু সে দায় কার? তা সত্ত্বেও আমাদের জন্য অন্য কেউ বিপদে পড়ুক, এমন কাজ তো করিনা !এই মহামারীটা যে আমরা আনিনি, এটাই আমাদের বড় স্বস্তি। জীবনে বোধহয় এই প্রথম আমরা আজ দোষারোপের উর্ধ্বে। শত প্রতিকূলতার মাঝে এটুকু স্বীকৃতি বোধহয় আমরা পেতে পারি, তাইনা? কিন্তু তবুও…..
    লকডাউন চলুক। আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা একটুখানি স্বাধীনতা চাই ধর্মাবতার। হাজার টাকা নয়, রোজানা একশো টাকার স্বাধীনতা। ধর্মাবতার,  মাত্র একশো টাকার স্বাধীনতা।কমপ্লিট উদরপূর্তি নয় ; মাত্র আধপেটা, উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা।  "আর কত চেঁচাবো বাবু দুটো ভাতের জন্য? তোমরা কি সব বধির হয়ে গেছে বাবুরা। কিছু কানে শোনো না। অন্তর কি তোমাদের পাষাণ হয়ে গেছে বাবু।…"(নবান্ন)--শ্রী শ্রমিক আহমেদের এই আর্তনাদ আপনারা কি শুনতে পাচ্ছেন?

শেখ রেজওয়ানুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ,WBES

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

স্বরুপনগরের ২৬ কিমি সড়কপথ সংস্কার হল

পাথরচাপরির দাতাবাবার টানে....

কোতলপুরে নেতাজির জন্মদিনে আসছেন ব্রাত্য বসু