কর্মবিরতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বিমুখী অবস্থান



মোল্লা জসিমউদ্দিন, 

লোকসভা নির্বাচনের   আগে এবং ভোট পরবর্তী সময়ে রাজ্যে যে দুটি ঘটনা শুধু  এই রাজ্য নয় সমগ্র দেশে প্রভাব ফেলেছিল। সেগুলি হল আইনজীবীদের কর্মবিরতি এবং চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। সময়ের ব্যবধানে অবশ্য দুটি কর্মবিরতি উঠে গেছে।তবে আপামর সাধারণ মানুষের মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে এই দুই ধরনের কর্মবিরতির কুপ্রভাব গুলি। অনেকেই অনেককিছু হারিয়েছে এইসব কর্মবিরতির ফলে। একাধারে যেমন আইনজীবীদের সৌসৌজন্যে বিচারধীন বন্দিরা কারাগারে পচেছে। ঠিক তেমনি আবার রোগ যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালের সামনে অসহায়ভাবে ছটভট করতে দেখা গেছে রোগীদের কে। গত সপ্তাহে শিয়ালদহের এনআরএস হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের উপর হামলার অভিযোগে রাজ্যব্যাপী চিকিৎসকরা কর্মবিরতির ডাক দেন। দিন পাঁচ ছয় চলার পর মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনায় তা উঠে। যদিও প্রথম পর্যায়ে মুখ্যমন্ত্রীর রনং দেহী অবস্থানে চিকিৎসকরা তীব্র অসন্তোষ অনেকখানিই মিটেছে। রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবায় স্বাভাবিক গতি এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসকদের কর্মবিরতির সপ্তাহ না ঘুরতেই যেভাবে আলোচনার মাধ্যমে প্রশাসনিক ও পুলিশগত দাবি গুলি পূরণ করেছেন। তাছাড়া তিনি নিজেও হাসপাতালে গিয়েছিলেন সরজমিন ঘটনার গভীরতা দেখতে। তাতে চিকিৎসকদের সিংহভাগই খুশি। এইরুপ অবস্থান মুখ্যমন্ত্রী আইনজীবীদের কর্মবিরতির সময় নিতে পারতেন। তাহলে কলকাতা হাইকোর্ট সহ রাজ্যের সমস্ত মহকুমা ও জেলা আদালতগুলিতে অচলাবস্থা থাকত না। এমনকি তিনি সেসময় মিডিয়ায় কোন উচ্চবাক্য করেন নি আইনজীবীদের কর্মবিরতি নিয়ে। তাঁর দলীয় এক বিধায়ক যিনি আবার 'বার কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ' এর পদাধিকারী তাঁর মাধ্যমে বিষয়টি দেখছি দেখব বলে বার্তা অবশ্য দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সারা রাজ্য জুড়ে আইনজীবীদের টানা একমাসের কর্মবিরতিতে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি আইনজীবী, লাখের কাছাকাছি ল ক্লাক ( মুহুরি), টাইপিস্ট   , আদালত চত্বরে থাকা শয়ে শয়ে  খাবার দোকান, জেরক্স, ডিটিপি দোকানগুলি যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?  মুখ্যমন্ত্রী যদি একটু আইনজীবীদের প্রতি সহৃদয় হতেন, তাহলে আদালতের উপর নির্ভর করা সারা রাজ্যের লাখ খানেক মানুষদের পেশাগত এত দুর্দিন আসত না। হাজার হাজার বিচারধীন বন্দি জেলের কারাগারে কিংবা পুলিশ লকআপে জামিনের অভাবে পচতো না। এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে জেলখানা গুলিতে তাদের বন্দি রাখার ভরণ ক্ষমতার বাইরে বন্দি রাখতে হচ্ছিল। বিভিন্ন আদালতে এজলাস গুলিতে বিচারকেরা মামলায় ডেটের পর ডেট ফেলা ছাড়া আর কিছুই তেমন করতে পারছিলেন না।  আদালতে থাকা পুলিশের জিআরও বিভাগগুলিতেও অনুরুপ পরিস্থিতি হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী কি পারতেন না একটু মানবিক হতে?  এই প্রশ্ন রাজ্যের বিভিন্ন আদালতের বার এসোসিয়েশন গুলির। নির্বাচনী বিধির দোহাই দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সপ্তাহের পর সপ্তাহ চুপ ছিলেন আইনজীবিদের কর্মবিরতিতে। যেখানে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি দিন তিনেকের মধ্যেই সক্রিয়তা দেখা যায় রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান কে। আইনজীবীদের কর্মবিরতি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্বনাথ সম্মাদার এর এজলাসে মামলায় বিচারপতি সেসময় এক আদেশনামায় রাজ্যের এডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত কে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের প্রতি রাজ্যের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। সেখানে দেখা যায় রাজ্যের তরফে কোন সুস্পষ্ট অবস্থান অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের নিয়ে বলেনি রাজ্য। অথচ বিচারপতি বারবার শুনানিতে বলেছিলেন -' পুলিশ অফিসারদের নিয়ে    রাজ্যের অভিমত পেলে নির্বাচন কমিশন কে কোন নির্দেশ দেওয়া হতে পারে'।  সিংহভাগ আইনজীবীদের প্রশ্ন - মুখ্যমন্ত্রী তো তখন রিপোর্ট দিতে পারতেন, কিন্তু তা করেন নি। এমনকি দেখা গেছে তৃনমূল প্রভাবিত রাজ্যের বার কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এর কর্মবিরতির  অবস্থান  নিয়ে রাজ্যের বেশিরভাগ আইনজীবী প্রকাশ্যে বিদ্রোহী হয়েছেন। কখনো সিটি সিভিল কোর্টের মূল গেটে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে। আবার কখনও সংবাদমাধ্যমের সামনে। বারবার অফিস ঘেরাও এর সম্মুখীন হতে হয় বার কাউন্সিল এর প্রতিনিধিদের কে। সেইসাথে বীরভূমের ডাকসাইটে নেতা অনুব্রত মন্ডলের হয়ে মামলা লড়তে গেলে আইনজীবী ( বার কাউন্সিল এর সদস্য) বৈশ্বানর চট্টপাধ্যায় কে তুমুল সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। পরে অবশ্য বার কাউন্সিল লোকদেখানো শোকজ ইস্যু করে থাকে। আইনজীবীদের প্রশ্ন ছিল,  যে সংগঠন  সারা রাজ্য জুড়ে আইনজীবীদের কর্মবিরতি ডাকলো, সেই সংগঠনের সদস্য কিভাবে কর্মবিরতি চলাকালীন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা লড়তে গেলেন সেই নিয়ে।   পরে দেখা যায় বার কাউন্সিল কর্মবিরতি তুলে নিলেও রাজ্যের বেশিরভাগ বার এসোসিয়েশন তাতে সহমত পোষণ করেনি।।গত ২২ মে বিচারপতি বিশ্বনাথ সম্মাদার আইনজীবীদের কর্মবিরতি মামলায় আদেশনামায় উল্লেখ রাখেন - হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের সাতজন পুলিশ কর্মী ক্লোজ থাকবেন, সেইসাথে হাওড়ায় কোন পুলিশি কাজে যুক্ত হতে পারবেন না। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কল্যাণ জ্যোতি সেনগুপ্তের নেতৃত্বে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গড়া হয়। আগামী ২৬ শে আগস্ট রিপোর্ট পেশ করবে এই তদন্ত কমিশন।গত ২৪ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত আইনজীবীদের বিরুদ্ধে  ১১ টি ফৌজদারি মামলাগুলি পর্য্যালোচনা করবে এই তদন্ত কমিশন। পুলিশ কোন একশন নিতে পারবেনা এইবিধ মামলায় অভিযুক্তআইনজীবীদের প্রতি। গত ২৪ এপ্রিল হাওড়া জেলা আদালতে গাড়ী রাখা নিয়ে আইনজীবীদের উপর পুলিশি সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠে। যেভাবে আদালতে ঢুকে এমনকি এজলাস গুলিতে পুলিশি সন্ত্রাস দেখা যায়। তাতে রাজ্যে আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল অসন্তোষ দেখা যায়। পরে কলকাতা হাইকোর্ট অবশ্য আদালতে ঢুকতে গেলে এসিজেম ( মহকুমা আদালত) ,  ডিস্ট্রিক্ট জাজ ( জেলা আদালত), রেজিস্ট্রার জেলারেল ( কলকাতা হাইকোর্ট) এঁদের অনুমতি ছাড়া আদালতের ভেতরে পুলিশের প্রবেশ নিষেধজারী করে থাকে। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির আন্দ্রোলনে সাড়া দিয়ে মাত্র দিন পাঁচ ছয় দিনেই মুখ্যমন্ত্রী সাড়া দিলেন। সেইসাথে একগুচ্ছ নির্দেশিকাজারীও করলেন। সেখানে টানা ত্রিশ দিনের আইনজীবীদের কর্মবিরতিতে মুখ্যমন্ত্রী কোন সাড়া দেন নি। তাতে মুখ্যমন্ত্রীর এহেন ভিন্ন অবস্থান নিয়ে তীব্র অসন্তোষ আইনজীবীদের মধ্যে।  কাটোয়া মহকুমা আদালতের ক্রিমিনাল মামলার আইনজীবী অনিন্দ চট্টরাজ বলেন - আমাদের কর্মবিরতির প্রথম দিকে মুখ্যমন্ত্রী একটু মানবিক হলে আমরা পেশাগত আয়ে এত ক্ষতির সম্মুখীন হতাম না।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                        

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

স্বরুপনগরের ২৬ কিমি সড়কপথ সংস্কার হল

পাথরচাপরির দাতাবাবার টানে....

কোতলপুরে নেতাজির জন্মদিনে আসছেন ব্রাত্য বসু